বাংলা কবিতা


কান্ডারী হুশিয়ার!
- কাজী নজরুল ইসলাম

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!


----------------------------------------

হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক
- কাজী নজরুল ইসলাম

হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুই আঁখি তারা
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।

যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী
যায় গো বয়ে নিরবধি
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।।

বুলবুল আর কোকিল পাখী
এক কাননে যায় গো ডাকি,
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।।

ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে
এক জননীর কোল লয়ে
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।।

পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী,
অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী।
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী
একই মায়ের বুকে খেলি,
পাগলা তা'রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।।



দুঃখ দিয়েছিলে তুমি
- পূর্ণেন্দু পত্রী

দুঃখ দিয়েছিলে তুমি
আবার লাইটারও দিয়েছিলে।
বোতাম ছিড়ে আমাকে লগ্ন করেছো
তুমি আবার বুনে দিয়েছো নাইলনের সবুজ জামা।
কমলালেবু নিংড়ে নিংড়ে বানানো সরবৎ
ভিতরে মিশিয়ে দিলে গোপন কান্নাকাটি
স্মৃতির পেস্তা-বাদাম
সেই সরবৎ খেতে হবে এখন প্রত্যহ
বাইশ বছরের যুবকটা যতদিন আমার
চুলের ভিতরে আঁচড়াবে
আগুন রঙের চিরুনি।
 

----------------------------------------

ভালোবাসা মরে গেছে গত গ্রীষ্মকালে
- মহাদেব সাহা

ভালোবাসা মরে গেছে গত গ্রীষ্মকালে
উদ্যত বাহুর চাপে, ধুলোমাটি কাদা লেগে গায়ে
শীতেতাপে ঝরে গেছে তার বর্ণ, মেধা
স্পর্শ করে আশি এই প্রেমহীন নারীর শরীর
মৃত চুল, উত্তাপবিহীন কিছু বয়সের ধুলো,
নীলাঞ্জনশোভিত নারীর মুখ
ফিকে থির পলকবিহীন
দুই চোখ খেয়ে গেছে পৌষের দুই বুড়ো কাক
তাহাকেই ধরে আছি, বেঁধে আছি
অসহায় স্তব্ধ আলিঙ্গনে ;
সহু বছরের এই রোদবৃষ্টিজলে, ঝড়ে, কুয়াশায়
নষ্ট হয়ে গেছে প্রেম, মুখের গড়ন তার, দেহের বাঁধন
অজন্তা মূর্তি লাস্য, শিল্পের মতন
সেই গূঢ় সম্ভষণ
তার কতোখানি বাকি আছে?অবশিষ্ট আছে?
তাহারা কি থাকে কেউ অনাদরে উপেক্ষায়
সারাদিনে একবেলা জলঢালা মৌন কেয়ারিতে
অজ্ঞাত নফর, তাহারা কি থাকে?
স্পর্শহীন, পরিচর্যহীন একাকী নিঃসঙ্গ আর কতোকাল
দগ্ধ হবে প্রেম।
 

----------------------------------------

আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---গীতাঞ্জলি

আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল,
গেল রে দিন বয়ে।
বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে।
একলা বসে ঘরের কোণে
কী ভাবি যে আপন-মনে,
সজল হাওয়া যূথীর বনে
কী কথা যায় কয়ে।
বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে।

হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে,
খুঁজে না পাই কূল;
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে
ভিজে বনের ফুল।
আঁধার রাতে প্রহরগুলি
কোন্‌ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,
কোন্‌ ভুলে আজ সকল ভুলি
আছি আকুল হয়ে।
বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে।
 

----------------------------------------


আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---গীতাঞ্জলি 
 
আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে;
চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে।
হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা,
ধাইতে ধাইতে লোপ ক'রে চলে সীমা,
কোন্‌ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে,
বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।
বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।

পুঞ্জে পুঞ্জে দূর সুদূরের পানে
দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে।
জানে না কিছুই কোন্‌ মহাদ্রিতলে
গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে,
নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে
কোন্‌ সে ভীষণ জীবন-মরণ রাজে।
বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।

ঈশান কোণেতে ওই যে ঝড়ের বাণী
গুরু গুরু রবে কী করিছে কানাকানি।
দিগন্তরালে কোন্‌ ভবিতব্যতা
স্তব্ধ তিমিরে বহে ভাষাহীন ব্যথা,
কালো কল্পনা নিবিড় ছায়ার তলে
ঘনায়ে উঠিছে কোন্‌ আসন্ন কাজে।
বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।
 

----------------------------------------